ঢাকা | বঙ্গাব্দ

শয়তানের নিঃশ্বাসে সম্মোহন!

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Feb 15, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন:
ad728

বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন হলো ডেভিলস ব্রিথের মাধ্যমে অন্যকে সম্মোহিত করে এক প্রকার ইচ্ছাকৃত উপায়ে কারোর নিকট হতে সর্বস্ব লুট করার ঘটনা শোনা যায়; কিছুক্ষত্রে CCTV ফুটেজ দেখেও এমনটা মনে হয় – তবে আদতেই বিষয়টি কি সত্য?

এখানে সত্য/মিথ্যা নির্ণয় করার আগে আমাদের কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে:

ফ্যাক্ট

(১) ডেভিলস ব্রিথ কি?

(২) এমন রাসায়নিক উপাদানের আদৌ কাউকে এতোটা দ্রুত সম্মোহিত করার সক্ষমতা আছে কি?

(৩) যদি এমনটা না হয় তাহলে এখানে মূলত কি ঘটে এবং কেনইবা ঘটে?!

সবার আগে আসা যাক ডেভিলস ব্রিথ কি?

প্রচলিত ডেভিলস ব্রিথ এর কেমিক্যাম হলো স্কোপোলামাইন বা হায়োসিসিন যার রাসায়নিক গঠন হলো C17H21NO4 (কার্বনের ১৭ টি পরমাণু, হাইড্রোজেনের ২১ টি পরিমাণু এবং নাইট্রোজেন ও অক্সিজের মূলক NO তথা প্যারোক্সোনাইট্রেট ৪ টি মূলকের সহযোগে সমযোজী বন্ধনের এক রাসায়নিক যৌগ) এবং এটি মূলত ট্রোপেন অ্যালকালয়েড।

ডেভিলস ব্রিথ তথা স্কোপোলামাইন প্রাকৃতিকভাবে অ্যাট্রোপা বেলাডোনা সহ আরও বেশ কিছু উদ্ভিদ হতে পাওয়া যায় এবং সেটা ল্যাবে কৃত্রিমভাবে তৈরী করা যায় [এটিকে ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করার অতীত ইতিহাস আছে]।

স্কোপোলামাইন এর বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব!

স্কোপোলামাইন তথা ট্রোপেন অ্যালকালয়েড মূলত অ্যান্টিকোলিনার্জিক বিশেষত্ব আছে যা কিনা মোশন সিকনেস তথা গতি অসুস্থতা এবং বমিবমি ভাব দূর করার জন্য ব্যবহৃত হয়; এই বিষয়টা আপনি সহজে উপলব্ধি করতে পারেন যখন কোথায় বেড়াতে যান তখন বাসে বসলেই যদি অস্বস্তি ও বমিবমিভাব হয় তখন আপনি যে জয়ট্রিপ জাতীয় ঔষধ খান তেমনি আরকি [Joyteip 300 mg (Hyoscine Hydrobromide)] এছাড়াও এটাকে এন্সেটিক এবং পোস্ট অপারেটিভ বমি নিরোদ্রেকের জন্য ব্যবহৃত হতো – যার হ্যালুসিনোজোনিক বৈশিষ্ট্য আছে; আর এটিই এই স্কোপোলামাইন এর সাইকোডেলিক বৈশিষ্ট্য যার কারনে এটাকে সাইকোট্রপিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা চলে; তবে এই সাইকোজেনিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও এটি আরও নানানভাবে চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এমন রাসায়নিক উপাদানের আদৌ কাউকে এতোটা দ্রুত সম্মোহিত করার সক্ষমতা আছে কি?

স্কোপোলামাইন এর যদিও সাইকোজেনিক বৈশিষ্ট্য আছে তবে সেটা বর্তমানের এমন প্রচলিত ঘটনার মতো এমন বৈশিষ্ট্য নেই যাতে আপনি খুব সহজেই হিপ্নোটাইজ হয়ে যাবেন এবং আপনার সমগ্র চেতনা হ্রাস পাবে এবং কর্তা (যিনি এই কাজটি করছেন) যা বলবেন তা অতি সহজেই সাবজেক্ট (যাকে হিপ্নোটাইজ করা হচ্ছে) কোনরূপ মূল্যায়ন না করেই সেটা গ্রহণ করবে; এখানে বিতর্কের অবকাশ নেই কেননা এমন কেমিক্যালের এইরূপ আদৌ বিশেষত্ব নেই “যা এতোটা অল্প সময়ে শুধুমাত্র একটুকু নিঃশ্বাসের হেতু বাতাসে সহজাত ন্যাচারাল উপায়ে ব্যাপন বা Spontaneous উপায়ে অনুগুলো মস্তিষ্কে পৌছে সেন্সারী নিউরনের সিগন্যাল ব্লক করে দিবে” তদুপরি যদিও লিথাল ডোজের অনেক কাছাকাছিও হয় তবে সেক্ষেত্রে যেকোন ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই সেন্সলেস হবে অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়বে; এখানে কেবলমাত্র মস্তিষ্কের লজিক্যাল ফাংশান [দ্রব্য হতে ব্যাপিত রাসায়নিক অনু > নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহন > মস্তিকের তড়িৎ রাসায়নিক সিগন্যালে ব্যাতিচার করা > কনশাসনেস বা লজিক্যাল চিন্তা ব্লক করা] ব্লক করিয়ে অন্যান্য শারীরিক পেশী সক্রিয় রাখবে [যেমন হাত দিয়ে নিজের পকেট হতে টাকা বা মোবাইল দেওয়া,  গহনা খুলে দেওয়া ইত্যাদি কর্ম] – এমনটা সম্ভবপর নয়।

এছাড়াও নাক ব্যতীত ত্বকের স্পর্শ যেমন হাত দিয়ে স্পর্শ বা গায়ে ছোয়ানো এমনটার মাধ্যমেও উহা কার্যত সম্ভবপর নয়।

যদি এমনটা না হয় তাহলে এখানে মূলত কি ঘটে এবং কেনইবা ঘটে?!

তাহলে প্রশ্ন আসে যে এখানে মূলত কি হয়? অন্যান্য সকল ঘটনা [যা অন্তত পুলিশ কেইস তথা ভিক্টিমের জবানবন্দি অনুসারে তদন্ত স্বাপেক্ষ] তথ্য পাওয়া যায় তাতে এমন স্পেসিফিক কেমিক্যালের হেতুই এমনটা হয়না বরং ঐ পরিস্থিতিতে ভিক্টিম’কে এমন একটি ঘটনার মাঝে পর্যবসিত করা হয় যেখন তিনি সুস্থ থেকেও তার স্বাভাবিক যৌক্তিক চিন্তা চেতনার ভ্যালিডেশান হ্রাস পায়; যেমন কোন একটি বিষয়ে লোভ দেখানো এবং সেটা যে আদতে সত্যিই এটা নানান পারিপ্বার্শিকতায় সাবজেক্টের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে [এখানে পরিবেশ, সিচুয়েশান,  ব্যক্তির বয়স, ইমোশন, প্রভাবক ইত্যাদি বিষয় কাজ করে] – এদের মূলত খড়পার্টি বলা হয় [খড়পার্টির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এরা ভ্রাম্যমান অর্থাৎ এরা কখনোই একটি স্থানে স্থায়ীভাবে থাকে না ফলে তাদের ট্রেসআউট করা এবং মূল মাস্টার মাইন্ড খুঁজে বের করা কঠিন]; এখানে হয়তো উদ্দীপনা জাগাতে অন্য কোন উপাদান ব্যবহৃত হতে পারে তবে সেটা এককভাবে কেবলমাত্র স্কোপোলামাইন হতে করা যায় এমনটি পসিবল নয়।

আপনি যদি চান তবে পত্রিকার বিভিন্ন ঘটনা কিংবা আপনার জানাশোনা ঘটনার মূল উদঘাটন করতে পারেন; এছাড়াও এখানে আরেকটি হিডেন সাইকোলজিক্যাল টার্ম আছে যা হলো “ভিক্টিম যেহেতু সেচ্ছায় তার অর্থ ইত্যাদি দিয়ে দিচ্ছেন (সেটা লোভ বা যেমন কারণেই হউক) তাই শেষটাতে যখন তিনি প্রতারনার স্বীকার হয়েছেন তখন এমনভাবে ঘটনার বিবৃতি করেন যাতে তার ইনোসেন্সিতে এমন কেমিক্যালের ওপর দায় বর্তানোর অবচেতন তাড়না থাকে” – অন্যদিকে কোন কিছু পড়তে দেওয়া বা মোবাইলের বাটন চাপা ইত্যাদি ঘটনা মূলত সাবজেক্ট বা ব্যক্তির প্রাথমিক (প্রাইমারি) সাজেশন দিতে এক প্রকার ক্রিয়াবাচক ইফেক্টিভিটি হিসেবে কাজ করে যখন তার মনোযোগকে একীভূত করার চেষ্টা করা হয় মাত্র।

অন্যদিকে কিছু কিছু ঘ্রাণ আমাদের সাইকোলজিক্যালি প্রভাবিত করার সক্ষমতা রাখে যেমন এমন পরিবেশ যাতে আতর আর গোলাপজল তাতে ধর্মীয় তথা বিশ্বাসগত বিষয়ের হেতু আপনার সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশনসে সাজেশন প্রদানে ক্রিয়াশীল হয় মাত্র।

স্কোপোলামাইন নিয়ে কেন এতো হাইপ?

স্কোপোলামাইন নিয়ে এতোটা হাইপ হওয়ার কারণ হলো এটা জনপরিচিত হয়েছে এমন হিপ্নোটিক প্রভাবের হেতু; যদিও তা পুরোটা সত্য নয় এমনকি ডেভিলস ব্রিথ সম্পর্কে যেসকল ভিডিও বা আর্টিকেল সারফেস ওয়েবে পাওয়া যায় সেগুলোর যথার্থতা উল্লেখ না করেই প্রচার এবং রেফারেন্স না থাকায় অজ্ঞতা এবং একটি বিশাল ব্ল্যাক মার্কেট ডিমান্ড তৈরী করা।

বিষয়টা আপনি Google এ সার্চ করলেই দেখতে পাবেন যে “স্কোপোলামাইন……” লিখলেই “স্কোপোলামাইন কোথায় কিনতে পাওয়া যায় / স্কোপোলামাইন কোথায় পাওয়া যায়” এমন সার্চ এপিয়ারেন্স মূলত বোঝায় কেন এটাতে আগ্রহের হেতু এতোটা হাইপ তোলার বিষয়টি। এছাড়াও ডিপ ও ডার্ক ওয়েবেও এটার চাহিদা বেশ (এসব বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘতর করা অনাবশ্যক তবে যতোটুকু তথ্য প্রদান সেটা নিজের হতে জানার পরই উল্লেখ করা – কোন শোনা কথা নয়)।

প্রতিকার ও প্রতিরোধ

অবশ্যই অপরিচিত কারোর কোন কথাতে সায় দেওয়া বা সহায়তার করার পূর্বে সচেতনতা কাম্য; এছাড়াও আপনার যদি মনে হয় এমন পরিস্থিতি বা সিচুয়েশান তৈরী হচ্ছে যাতে আপনাকে কেন্দ্র করে কোন অঘটনের ক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে তবে দ্রুতই ঐ স্থান ত্যাগ করে অনত্র আশেপাশের রিলায়েবল অবস্থানে পৌছান এবং পর্যাপ্ত পরিমানে পানি গ্রহন করুন (হাইড্রেট হওয়ার জন্য); দ্রুতই অন্যদের সহায়তা গ্রহন করে নিকটস্থ থানাতে যোগাযোগ করুন এবং সত্যাতিসত্য ঘটনার বর্ণনা করুন। দ্রুতই লাভবান হবেন কিংবা ইমোশনাল ঘটনা (অপরিচিত) গুলোতে নিজেকে ইনফ্লিক্ট করার পূর্বে সচেতন হউন।

তথ্যসূত্র ও রেফারেন্স:

স্কোপোলামাইন সম্পর্কে রাসায়নিক গঠন (তথ্য): উইকিপিডিয়া

স্কোপোলামাইন এর মেডিকেল বৈশিষ্ট্য (রেফারেন্স): সায়েন্স জার্নাল

স্কোপোলামাইন এর বায়ো কেমিক্যাল ইফেক্ট (তথ্য ও রেফারেন্স): মেডিকেল জার্নাল

স্কোপোলামাইন এর সাইকোজেনিক বৈশিষ্ট্য (রেফারেন্স) : সায়েন্স জার্নাল

স্কোপোলামাইন হাইপ (তথ্য) : তথ্য ও উপাত্ত (নিউজ)

স্কোপোলামাইন এর নামে খড়পার্টি (তথ্য): তথ্য ও উপাত্ত (নিউজ)


নিউজটি আপডেট করেছেন : দেশ ৭১

কমেন্ট বক্স